Magic Lanthon

               

প্রদীপ দাস

প্রকাশিত ৩১ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

 ‘পাপাত্মা’র বিপরীতে ‘মহাত্মা’ নির্মাণে গান্ধী

প্রদীপ দাস


তত্ত্ব নির্মাণের নিমিত্তে

শোষণ আর শাসনের মাত্রা চরমে পৌঁছালে মানুষ বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকুও হারায়। তখন মানুষ তাদের রক্ত-মাংস চুষে খাওয়া শাসক ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজপথে নামতে আর ভয় পায় না। ইউরোপে সামন্তযুগে একবার এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হলে, রাস্তায় নেমে আসে শোষিত মানুষ। ফলে রাজা ও চার্চের একটানা স্বৈর-আধিপত্যের ভিত নড়ে ওঠে। এই আন্দোলন, প্রতিবাদকে দমন করতে সামন্তপ্রভুরাও নারকীয় সব পথ অবলম্বন করে। যেসব নারী সেসময় প্রচলিত নিয়ম ভেঙে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলো তাদেরকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে শুরু হয় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। প্রায় ৬০ লক্ষ ডাইনিকে হত্যা করা হয়েছিলো ওই সময়।

রাজা ও চার্চ আন্দোলন প্রতিরোধের জন্য যে ডাইনি সৃষ্টি করেছিলো¾ওই প্রজেক্টে তারা সফল। কারণ এতো সংখ্যক ডাইনি হত্যা করেও তাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কারণ, ডাইনিদের হত্যা করা যায়। ডাইনিদের হত্যা করলে সমাজ থেকে দূর হয় পাপ-অমঙ্গল। আর সমাজের মানুষও ডাইনির মতো পাপাত্মার কাছ থেকে মুক্তি চায়। অথচ রাষ্ট্রযন্ত্রই প্রয়োজন মতো এভাবে ডাইনিরূপী পাপাত্মা¾হিন্দু, মুসলিম, শিখ, চরমপন্থি, জঙ্গি, নাশকতাকারী, সন্ত্রাসীদের জন্ম দেয়। আবার এই পাপাত্মাকেই রাষ্ট্র নিধন করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য।

পরিস্থিতি এমন হয় যে, এই শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে জনসাধারণের যেনো একটা নীরব সমর্থন তৈরি হয়। এর প্রমাণ মেলে, ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ সেপ্টেম্বর ১২টি বৌদ্ধবিহার ও মন্দির এবং ৪০টি বাড়িতে আগুন দেওয়ার সাম্প্রদায়িক ঘটনায়। এই ঘটনায় রাষ্ট্রযন্ত্র অনেক কষ্টে চরমপন্থি মুসলমান বা জঙ্গি এর সঙ্গে জড়িত¾এ তকমা লাগাতে সক্ষম হয়। ফলে চরমপন্থি মুসলমান বা জঙ্গি সম্পর্কে আমাদের মনে যেমন একধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়, তেমনই রাষ্ট্রও তার দায় থেকে মুক্তি পায়। এরপর রাষ্ট্র তার শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন শুরু করে। তাই বন্দুকযুদ্ধেচরমপন্থি বা জঙ্গি মারা গেলে জনগণের মনে কোনো প্রশ্নের উদ্রেক হয় না।

এই পাপাত্মা সৃষ্টি ও ধ্বংসের সঙ্গে রাষ্ট্র আরেকটি কাজ করে¾স্বাভাবিকীকরণ। আর সেজন্যই বোধহয় মানুষের চেয়ে সহনশীল প্রাণী পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এর সম্ভাব্য কারণ, সে সব রকম পরিস্থিতিতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। তাই বিদ্যালয়ে হামলা করে ৩০-৪০ জন শিশু হত্যা, মসজিদে স্বধর্মাবলম্বীদের হামলায় হত্যাযজ্ঞ, সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে শিরশ্ছেদের ভিডিও প্রকাশ, বিহারি পল্লিতে একই পরিবারের নয় জনকে পুড়িয়ে হত্যা; আবার এই সব অপকর্ম বন্ধ করতে আইনি সহিংসতায় মানুষ হত্যা¾কোনো কিছুই আর অনুভূতিকে স্পর্শ করে না! ফলে আবারও রাষ্ট্রই জিতে যায়।

তবে মজার বিষয় হলো, পাপাত্মার মতো অনেক ক্ষেত্রে মহাত্মার সৃষ্টিও এই রাষ্ট্র বা শাসকদেরই। তবে এটা এতো সূক্ষ্মভাবে করা হয়, যা খালি চোখে দেখা যায় না। এটা বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধকতা অন্ধবিশ্বাস আর অনুসন্ধিৎসার অভাব। তবে এই বিষয়গুলো যারা অতিক্রম করতে পেরেছেন, তারা এর ভেদ বের করতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছেন। যাই হোক, মানুষকে কীভাবে মহাত্মা ও পাপাত্মা করে নির্মাণ করতে হয় তার ভালো একটা নজির হতে পারে ব্রিটিশ নির্মাতা রিচার্ড অ্যাটেনবরোর চলচ্চিত্র গান্ধী (১৯৮২)। এই আলোচনা গান্ধীকে নিয়েই।

নির্মাতা অ্যাটেনবরোর কোষ্ঠি বিচার ও গান্ধী

১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে গান্ধী নির্মাণের আগে রিচার্ড অ্যাটেনবরোর অভিনেতা হিসেবে খ্যাতি থাকলেও, নির্মাতা হিসেবে তেমন সমাদৃত ছিলেন না। গান্ধী নির্মাণের পর এটি এশিয়াসহ সারাবিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তাই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের সুযোগ যার বদৌলতে হয়েছিলো, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল করেননি অ্যাটেনবরো। তিনি যে তিন জনকে চলচ্চিত্রটি উৎসর্গ করেন, তাদের মধ্যে টাইটেল কার্ডে প্রথমে আসে মতিলাল কোঠারির নাম। তিনি ভারতীয় হাইকমিশনে ছোটোখাটো একটা চাকরি করতেন। ১৯৫০ দশকের শেষ দিকে হৃদপিণ্ডে সমস্যা দেখা দেয় কোঠারির। কেবল গান্ধীজির প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকে অসুস্থতা সত্ত্বেও তাকে নিয়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণে তিনি প্রতিজ্ঞ হন।

মতিলাল কোঠারি প্রথমে যে কাজটি করেন তা হলো, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জীবনীকার লুই ফিসার-এর কাছে তার বইটি নিয়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণের অনুমতি চান। ফিসারও কোনো শর্ত ছাড়াই ভালোবাসার জায়গা থেকে বইটি ব্যবহারের অনুমতি দেন। মতিলাল ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে অ্যাটেনবরোকে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রস্তাব দিলে তিনি পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৩-তে সম্মতি দেন। এরপর দীর্ঘ ২০ বছর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অ্যাটেনবরো ১৯৮২-তে চলচ্চিত্র নির্মাণ শেষ করেন। গান্ধী মুক্তির পর অ্যাটেনবরো সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমি দর্শকদের কাছে একজন নির্মাতা হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই না। আমি চাই একজন গল্পকার হিসেবে মানুষের অন্তরে চিরদিন বেঁচে থাকতে। অ্যাটেনবরো ঠিকই ‘গল্পকার’ হিসেবে বেঁচে আছেন। পরের আলোচনায় প্রতি পদে গান্ধীকে নিয়ে তার ‘গল্প’ বলার প্রমাণ পাওয়া যায়।

অ্যাটেনবরো ছাড়াও গান্ধীকে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের ডেভিড লিয়েন, স্যাম স্পিগেল ও গ্যাব্রিয়েল প্যাস্কাল চলচ্চিত্র-নির্মাণের চেষ্টা করেন। গান্ধীকে নিয়ে তাদের এই আগ্রহ দেখে মনে জিজ্ঞাসার উদ্রেক হয়। ব্রিটিশদের বিতাড়িত করার পিছনে দৃশ্যত যে গান্ধীর এতো অবদান, সেই গান্ধীকে নিয়েই চলচ্চিত্র-নির্মাণে তাদের এতো আগ্রহ! এর পিছনের সম্ভাব্য কারণগুলো খুঁজে দেখা যেতে পারে।

প্রথমত, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে সাধারণত ব্রিটেনসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো আদর্শ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। কারণ সভ্যতার তকমা এঁটে এরা একসময় সারাবিশ্বকে শাসন করেছিলো। এই তকমা তারা আরো এক ধাপ এগিয়ে নেয়, ব্রিটিশ-বিরোধী গান্ধীকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। গান্ধীকে নিয়ে তাদের খেলা এখনো শেষ হয়নি। তাই লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কয়ারে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল-এর ভাস্কর্যের উল্টোপাশেই তারা বসিয়েছে গান্ধীর মূর্তি। সাবেক প্রতিপক্ষ চার্চিল যাকে অর্ধ উলঙ্গ বলে অভিহিত করেছিলেন, তার উল্টোপাশে গান্ধীর মূর্তি স্থাপন করে ব্রিটিশরা আবারও প্রমাণের চেষ্টা করে তারা ভিন্ন মতকেও স্থান দেয়! এভাবেই তারা বার বার নিজেদের ‘শ্রেষ্ঠত্বকেই তুলে ধরে।

দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশরা গান্ধীকে পরমাত্মীয় বলে জ্ঞান করতো। এ রকমটা হওয়ার সম্ভাব্য কারণ ছিলো গান্ধীর আদর্শগত অবস্থান। একবার দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীকে শুধু গাত্র বর্ণের কারণে ট্রেন থেকে লাঞ্ছিত করে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো। কারণ প্রথম শ্রেণির কামরায় শ্বেতবর্ণ ছাড়া কোনো ভারতীয় বা কৃষ্ণাঙ্গ চড়তে পারতো না। এ বিষয়টি গান্ধী মেনে নিতে পারেননি। তাই সেখানে ভারতীয়দের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন।

তবে একটি বিষয় তিনি ঠিকই মেনে নিয়েছিলেন, তা হলো ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদ। তাই আন্দোলনে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করেননি। তাই গান্ধীতে তাকে বার বার বলতে শোনা যায়, উই আর মেম্বারস অব দ্য অ্যাম্পিয়ার ... আওয়ার রাইট টু বি ট্রিটেড অ্যাজ ইকুয়াল সিটিজেন অব দ্য অ্যাম্পিয়ার। এখন কথা উঠতে পারে, পরবর্তী সময়ে গান্ধী ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন করেছেন¾এ কথা তো সর্বজনবিদিত। তবে এ কথাও সত্য¾তিনি ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ অসহযোগ প্রভৃতির কয়েক বৎসর পরেও ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন।

তৃতীয়ত, ভারতবর্ষ বৈচিত্র্যময়। তাই এখানে সব ধরনের সম্পদই সহজলভ্য। ফলে প্রাচীনকাল থেকেই এখানে আগমন ঘটেছে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর। তবে মধ্যযুগে যে জাতি-গোষ্ঠীদের আগমন ঘটে, তাদের বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য ছিলো বাণিজ্য। পরে ক্ষমতায় গিয়ে তারা এরই প্রতিফলন ঘটান। রিচার্ড অ্যাটেনবরোও এই লুটেরার চরিত্রকে অস্বীকার করতে পারেননি। তাই তিনি ভারতবর্ষের বিশাল বাজারকে ধরার জন্য বেছে নিলেন গান্ধীকে। শুধু ভারতবর্ষ নয়, আফ্রিকা, প্রতীচ্যসহ পুরো বিশ্বের বাজার ধরার জন্য গান্ধী ছিলো উত্তম চরিত্র। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে একটুও ভুল করেননি অ্যাটেনবরো। তাই গান্ধী নির্মাণ করতে দীর্ঘ সময়সহ খরচ করেন ১৫ মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড। এর বিনিময়ে গান্ধী ৬০ মিলিয়ন পাউন্ড আয় করে ১৯৮২ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আয়ের ১২টি চলচ্চিত্রের একটি হিসেবে সমাদৃত হয়। অ্যাটেনবরো এভাবেই গড়ে তোলেন পুঁজির পাহাড়। তাই তিনিই সম্ভবত চলচ্চিত্রের জগতে রবীন্দ্রনাথ কথিত শেষ বড় ইংরেজ।

ইতিহাসের রিপ্রেজেন্টেশন, সত্য খোঁজার দায়

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যখন আসন্ন, মুক্তির উল্লাসে মানুষ যখন মেতে উঠবে, তখনই বাধ সাধে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্ব। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ শত বুঝিয়েও তাকে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরাতে পারলেন না। মহাত্মা গান্ধী বলেন, আমি চাই তুমিই (জিন্নাহ) ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হও ...। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো, কিন্তু গান্ধী এই স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারলেন না। তাই তার বাড়িতে ভারত কিংবা পাকিস্তানের পতাকা উড়তে দেখা গেলো না।

অ্যাটেনবরো এভাবেই রঙ, ভাষা, চিত্র, ধারণা দিয়ে চলচ্চিত্রে অসাম্প্রদায়িক গান্ধীকে রিপ্রেজেন্ট করলেন। তার এই উপস্থাপন গান্ধীকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়। কিন্তু গান্ধী সত্যিই কি এতটাই অসাম্প্রদায়িক বা মহত্ত্বের অধিকারী ছিলেন? আর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে উপস্থাপন করা হয় পৃথিবীর এক অভিশপ্ত প্রাণী হিসেবে। যার কারণে দেশভাগের সময় ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু এবং এক কোটি মানুষকে দেশান্তরী হতে হয়েছে। কিন্তু জিন্নাহর এ রকম সিদ্ধান্তের পিছনের কারণ কী বা কীভাবে তার এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি হলো? কিংবা তৎকালীন ক্ষমতাসীন ব্রিটিশদেরই এতে কী ভূমিকা ছিলো¾এ নিয়ে একটি কথাও গান্ধীতে বললেন না অ্যাটেনবরো! তাই গান্ধীর বাইরে গিয়ে এর কারণ খোঁজার প্রয়াস চালানো যেতে পারে।

আর্যরা যখন বৈদিক যুগে ভারতবর্ষে আসে তখন কোনো শ্রেণিভেদ ছিলো না। আর্যরা ছিলো দীর্ঘকায়, উন্নত নাসিক্য ও দেখতে ‘সুন্দর। আর ভারতের আদিম অধিবাসী অনার্যরা দেখতে কৃষ্ণকায় ছিলো। কৃষ্ণকায় অনার্য জাতিকে পরাজিত করে যখন আর্যরা এখানে বসতি স্থাপন করলো, তখন দুটি শ্রেণির জন্ম হয়। গায়ের রঙের ভিত্তিতে প্রথমে দুটি শ্রেণি টিকে থাকলেও একসময় তাদের মিশ্রণে জনসংখ্যা বাড়ে, জটিল হয় জীবন ধারণ। ফলে এই শ্রেণি দুটির বিলুপ্তি ঘটিয়ে কর্মক্ষমতা বা গুণের ভিত্তিতে সমাজে চারটি শ্রেণির জন্ম হয়। এদের মধ্যে পূজা-পার্বণ, শাস্ত্রপাঠে পারদর্শীদের ব্রাহ্মণ; অস্ত্রের ব্যবহার ও দেশরক্ষায় পারদর্শীদের ক্ষত্রিয়; ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও পশুপালকদের বৈশ্য এবং এই তিন শ্রেণির সেবায় নিয়োজিতদের বলা হতো শূদ্র।

বৈদিক যুগের শেষের দিকে ব্রাহ্মণদের কর্মকাণ্ড ও বৈষম্য বেড়ে যায়। ‘ব্রাহ্মণশ্রেণীর প্রাধান্য স্বীকার, যাগযজ্ঞ, বলিদান প্রভৃতি যেমন শ্রেষ্ঠ ধর্ম কার্য বলিয়া বিবেচিত হইত, তেমনি নিম্নশ্রেণীর (শূদ্র) প্রতি উচ্চশ্রেণীর ঘৃণাপ্রদর্শন অন্যায় বলিয়া মনে করা হইত না। জীবহিংসা এবং মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা ধর্মের অংশে পরিণত হইয়াছিল। ফলে জৈন ও বৌদ্ধধর্ম সামাজিক জীবনের সহজ-সরল জীবনাদর্শ প্রচার করলে এই নির্যাতিত নিম্নশ্রেণির মানুষ এই ধর্ম দুটি গ্রহণ করে। এর মধ্যে প্রভাব বিস্তারকারী বৌদ্ধধর্মে রাজার অনুগ্রহ কমলে ও তান্ত্রিকতা বেড়ে গেলে আর্যধর্ম আবার জনপ্রিয়তা পায়। আর্যধর্মের নবজীবন প্রাপ্তির পর বৌদ্ধদের ভারতবর্ষে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এ রকম পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম রাজশক্তি প্রতিষ্ঠা হলে ভীত-সন্ত্রস্ত বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলাম ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে।

ভারতবর্ষে নতুন রাজশক্তি বা ধর্ম প্রতিষ্ঠা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা আশাতীত হারে বৃদ্ধি পায়। মৌলিক উৎপাদন পদ্ধতির মধ্যে কোনো পরিবর্তন না ঘটায়, নিম্নশ্রেণিটির বড়ো একটি অংশ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্দশার হাত থেকে আত্মরক্ষার তাগিদে ক্রমাগত ধর্ম পরিবর্তন করে আসছিলো। এভাবেই ধর্মের মধ্যে মুক্তি খুঁজতে গিয়ে নিচু জাতের মানুষজন বার বার ধর্ম নামক গরম খোলা থেকে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে। কিন্তু ধর্ম তাদের মুক্তি দেয়নি, বরং পুড়িয়েই গেছে চিরকাল।

ভারতবর্ষে এই বর্ণপ্রথাই সাম্প্রদায়িকতার আদিম উৎস। যার গোড়ায় অধিকাংশ সময়ই জল দিয়ে এসেছে ক্ষমতাসীন হিন্দু শাসকশ্রেণি। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হলে ভারতীয়দের স্বার্থ রক্ষার্থে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু কংগ্রেসের নেতৃবর্গের বেশিরভাগই হিন্দু হওয়ায় এটি সর্বভারতীয় না হয়ে হিন্দুদেরই স্বার্থ রক্ষার্থে কাজ করে। আবারও বঞ্চিত হয় মুসলমান অর্থাৎ নিম্নশ্রেণিটি। তাই বরাবরই বঞ্চিত হয়ে আসা মুসলমানরা তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম লীগ। ক্ষমতাসীন হিন্দু শ্রেণির শাসন থেকে মুক্তির জন্য শুরু থেকেই যার ছিলো বিচ্ছিন্নতার মতাদর্শ। দলটির দাবি মুসলিমরা স্বতন্ত্র জাতি। তাই ভারতবর্ষে তাদের অধিকার রক্ষায় আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজন।

তবে মুসলমানদের স্বতন্ত্রজাতি’র ধারণাটি খুব বেশি পুরনো নয়। ধারণাটি ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে সিমলা ডেলিগেশনে প্রথম উঠে আসে। বিষয়টি নিম্নশ্রেণি ও ধর্মভীরু মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ফলে জিন্নাহ বৈঠকে ওঠা আপাত অসম্ভব ধারণাটিকে জনপ্রিয়তা দিয়ে জাতীয় দাবিতে পরিণত করেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যখন অবশ্যম্ভাবী, তখন জিন্নাহ এই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দুটি রাষ্ট্রের জন্মকে নিশ্চিত করেন। এর মাধ্যমে ধারণাটি তত্ত্ব হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়। কংগ্রেসের বিপরীতে মুসলিম লীগের জন্ম হওয়ায়¾

জিন্না তাঁর এই বিশ্বাসের ওপর জোর দিতেন যে ধর্মীয় ঔক্যবোধ জাতীয়তার সংজ্ঞা হতে পারে। এই যুক্তির অনেক ফাঁক-ফোকর আছে, কিন্তু জিন্নার কাছে এটাই ছিল একমাত্র মতাদর্শ, যা তিনি বর্মের মতো পরিধান করেছিলেন। হিন্দু ধর্ম বা হিন্দু জনসাধারণ নয়, জিন্নার বিরোধিতা ছিল কংগ্রেসের প্রতি, যাকে তিনি মুসলিম লিগের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন এবং নিজেকেই মনে করতেন লিগ।

কংগ্রেস-বিরোধিতা থেকে জিন্নাহর দেশভাগে এই তত্ত্ব ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়ে সংশয় থাকলেও, এটি যে এ উপমহাদেশের সমাজ, রাজনীতিতে এক সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে তা আজও বহমান; চলবে আরো দীর্ঘকাল¾এতে হয়তোবা কোনো সংশয় নেই। তাই হয়তো জিন্নাহর এই হিংসাত্মক কর্মকে ঘৃণা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিন্তু ‘মুসলিমরা স্বতন্ত্র জাতি¾’এই তত্ত্ব জন্মের পিছনে ক্ষমতাসীন হিন্দু শাসকশ্রেণির যে ভূমিকা তা নিয়ে চলচ্চিত্রে অ্যাটেনবরো কোনো কথা বলেননি!

মহাত্মা গান্ধী; জন্ম গুজরাটের রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে। পরিবারের সবাই ছিলো নিরামিষভোজী। গান্ধীও এ থেকে বাদ যান না। এটা কোনো সমস্যাও নয়। তবে সঙ্কট হলো, তিনি এটাকে কঠোরভাবে মেনে চলতেন, কিছুতেই এর ব্যত্যয় ঘটতে দিতেন না। আর এ দিয়েই জানান দিতেন তিনি বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিংবা মুসলমান নন¾শুধুই হিন্দু। হয়তো তিনি মানুষ-গান্ধীর চেয়ে হিন্দু-গান্ধী হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এই চাওয়া, শারীরিক গঠন, জীবনাচরণ ও কর্ম তাকে দিয়েছে দেবত্বের আসন। তাই জীবদ্দশাতেই গান্ধী লক্ষ লক্ষ হিন্দু দ্বারা দেবজ্ঞানে পূজিত হয়েছেন। তিনি তা সাদরে গ্রহণও করেছেন। তার এই দেবত্ব অর্জনের প্রাণপণ প্রচেষ্টা ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান বিভেদকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। অ্যাটেনবরোর গান্ধীতে এই গান্ধীও অনুপস্থিত।

ব্রিটিশদের ভূমিকায় বলতে হয়, দেশভাগ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো না। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের দাঙ্গা, বিভিন্ন সময়ের সাম্প্রদায়িক ঘটনা কিংবা হিন্দু-মুসলিম বিভেদের চূড়ান্ত রূপ হলো সাম্প্রদায়িক দেশভাগ। এবারে দেখা যাক, ক্ষমতাসীন ব্রিটিশ সরকার কীভাবে এই সাম্প্রদায়িক দেশভাগকে প্রভাবিত করেছে। ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার আগে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা, সংঘর্ষ তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। সাম্প্রদায়িক মন্তব্য, সংঘর্ষ কিংবা হিংস্রতার স্বল্পতার বিচারে এ কথা বলা যায়। কিন্তু ব্রিটিশরা ক্ষমতায় এসে নিজেদের স্বার্থে হিন্দুদের ব্যবহার করে এবং তাদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে থাকে। ফলে হিন্দুরা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে মুসলমানদের চেয়ে অনেক এগিয়ে যায়। এভাবে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে ব্রিটিশরা।

ফলে, এক ধর্মীয় গোষ্ঠী অন্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর আচার-আচরণ, মূল্যবোধকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও অস্বাভাবিক মনে করতে থাকে। একই সঙ্গে ধর্মীয় দলগুলির স্বার্থের সঙ্গেও নিজেদের অভিন্ন মনে করতে থাকে সাধারণ হিন্দু-মুসলিমরা। এতে তাদের মধ্যে তৈরি হয় আন্তঃদলীয় সংঘর্ষ। আর এই সংঘর্ষগুলোতে বিভিন্নভাবে ইন্ধন যোগাতে থাকে ক্ষমতাসীন ব্রিটিশরা। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এরই ফসল। এছাড়া মূল বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা এবং পরবর্তীকালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন মোকাবেলা¾উভয় ক্ষেত্রেই ব্রিটিশদের ভূমিকা ছিলো মুখ্য। দেশভাগের যে সীমারেখা টানা হয়েছিলো তাও অনেকটাই বঙ্গভঙ্গের সীমারেখা বরাবর। অথচ দেশভাগের পিছনে ব্রিটিশদের ভূমিকা নিয়ে একটি কথাও বললেন না অ্যাটেনবরো! ফলে ইতিহাস নির্মাণ হলো ঠিকই, কেবল তার রিপ্রেজেন্টেশনটা থাকলো ভিন্ন।

বাদ পড়া সারথিরা

শাসকশ্রেণি কেবল শাসনযন্ত্রে তার প্রভুত্বকেই প্রতিষ্ঠা করে না, সৃষ্টি করে এক সার্বিক সামাজিক কর্তৃত্ব। কেবল রাষ্ট্রীয় শক্তিকে অবলম্বন করে এই সার্বিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় না। সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শে পরিবর্তন ঘটিয়ে শাসকশ্রেণি সামাজিক সম্মতিও আদায় করে নেয়। অধস্তন বা শোষিতশ্রেণির কাছ থেকে এই সামাজিক সম্মতি আদায় করতে তারা আশ্রয় নেয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির। তাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ঘাঁটাঘাঁটি করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেরিয়ে আসে কেবল ক্ষমতাসীনদের কথা। আর ক্ষমতাসীনদের নির্মিত শিল্পে খুঁজে পাওয়া যায় না সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে। কিংবা তাদের চরিত্রকে বোঝার জন্য উঠে আসে না ওদেরই প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমালোচকদের কথা; আর কখনো আসলেও তাতে থাকে অনেক বিকৃতি। অথচ ওই ক্ষমতাসীনরা যখন ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে, তখন তারাও চলে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। সাধারণত এভাবেই চর্চা হয়ে থাকে সাধারণ ইতিহাস, সেখানে আর যাই হোক, সাধারণ থাকে সবসময়ই উপেক্ষিত।

শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ শাখা চলচ্চিত্রেও ইতিহাসের এই বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। গান্ধীও এর ইঙ্গিত বহন করে। কারণ, এই চলচ্চিত্রে গান্ধীর বিপরীতে ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ও নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু অনুপস্থিত। গান্ধীকে নিয়ে চলচ্চিত্র-শিল্প-সাহিত্য যা-ই হোক না কেনো, এই দুই নেতাকে বাদ দিয়ে তা অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই গান্ধীকে বোঝা বা ভারতবর্ষের ইতিহাসের পূর্ণতার স্বার্থে এই দুই নেতাকে নিয়ে আলোচনা ন্যায়সঙ্গত। আম্বেদকর-গান্ধী প্রসঙ্গে অরুন্ধতী বলেন, গান্ধী-র গল্প থেকে আম্বেদকর-কে বিচ্ছিন্ন করা যে গল্প শুনে আমরা বড় হয়েছি, সেটা একটা হাস্যকর বিকৃতি। একইভাবে আম্বেদকার-এর অপকার করা, কারণ অবিস্ময়করভাবে গান্ধী, আম্বেদকার-কে বিবিধভাবে ঘিরে আছে।১০ চলচ্চিত্রে আম্বেদকরের অনুপস্থিতিও একইভাবে গান্ধীর জন্য ক্ষতিকর। গান্ধী-আম্বেদকরের দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক জীবনে এমন কিছু ঘটনা রয়েছে যা চলচ্চিত্রে আসাটা বাঞ্ছনীয় ছিলো, অন্তত গান্ধীকে বোঝার স্বার্থে।

মহাত্মা গান্ধীর ২২ বছর পর ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর আলো-বাতাসের স্বাদ নেন আম্বেদকর। বয়সে কনিষ্ঠ হলেও ভারতের রাজনীতিতে তার গুরুত্ব গান্ধীর চেয়ে কম ছিলো না। দুজনেই ভিন্ন স্বার্থের গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতেন। দুজনেই তাদের অনুসারীদের কাছ থেকে দেবতুল্য ভালোবাসা পেয়েছেন। তারা যা বলেছিলেন, যা করেছিলেন হালের রাজনীতিতেও তার তাৎপর্য রয়েছে। তাদের মতপার্থক্যে কখনো সন্ধি হয়তো সম্ভব ছিলো না, এখনো সম্ভব নয়।

প্রথমবার আম্বেদকর-গান্ধী দ্বন্দ্ব জনসমক্ষে আসে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে; যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ছিলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ওই গোলটেবিল বৈঠকে আম্বেদকর অচ্ছুতদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি তোলেন। সেখানে গান্ধী অচ্ছুতশ্রেণির সমস্যাকে মামুলি বলে উপেক্ষা করতে চাইলে আম্বেদকর বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করে কড়া যুক্তি তুলে ধরেন। পরে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় বৈঠক। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচন এবং দ্বৈত ভোটাধিকার (দ্বৈত ভোটাধিকার হলো¾একটি ভোট নিজের প্রার্থীকে এবং অন্যটি সাধারণ প্রার্থীকে দিতে পারবে) ব্যবস্থা স্বীকৃত হয়। এতে হিন্দুদের সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ফলে রাজনৈতিক জীবনের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে চলেছে বলে, এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমরণ অনশন শুরু করেন গান্ধী। এ সময় এক বক্তৃতায় আম্বেদকর বলেন,

... এটা দুঃখের বিষয় যে, গান্ধিজী নির্যাতিত শ্রেণীর জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে আমরণ অনশন শুরু করেছেন। সকলে যে তাঁর মূল্যবান জীবন রক্ষার জন্য ব্যাকুল হবেন এটাই স্বাভাবিক। আপনারা হয়তো আমাকে নিকটতম ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে গুলি করে মারতে পারেন, কিন্তু আমি যে পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্যভার গ্রহণ করেছি তা থেকে আমি বিচ্যুত হতে পারবো না। ... আপনারা বরং গান্ধিজীকে এক সপ্তাহের জন্য অনশন বন্ধ রাখতে অনুরোধ জানান এবং এই সময়ের মধ্যে কোন না কোন একটা সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে।১১

এদিকে গান্ধীর শারীরিক অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। বিষয়টি আম্বেদকরকে চিন্তিত করে তোলে। গান্ধীর কিছু হয়ে গেলে দাঙ্গা বাধার আশঙ্কা থেকে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হন তিনি। আম্বেদকর সমঝোতায় আসলেও এ বিষয়টা মেনে নেওয়া একটু কষ্টকরই যে, ভারতের সংখ্যালঘুদের পৃথক নির্বাচনের এমন তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এবং সেখানে গান্ধীর ভূমিকা চলচ্চিত্রে স্থান পায়নি!

এখানেই শেষ নয়। এই আপস চুক্তিতে গান্ধীজি যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন তাও অভিনব। ব্রিটিশ কর্তৃক সাম্প্রদায়িক বণ্টনের ভোট পদ্ধতিতে ৭৮টি আসনের পরিবর্তে নির্যাতিতদের জন্য একশো ৪৮টি আসন বৃদ্ধি করা হলেও, তাদের কাছ থেকে দ্বৈত ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এর ফলে সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে অস্পৃশ্যদের ক্ষমতা পুরোপুরি খর্ব হয়। যা কুখ্যাত পুনা চুক্তিনামে পরিচিত। ভারতীয় ইতিহাসে এই চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেখানে গান্ধীর নেতিবাচক ভূমিকা থাকায় তাও চলচ্চিত্রে স্থান পায়নি।

গান্ধী দেখার পর যেকোনো দর্শকেরই মনে হতে পারে, ভারতের স্বাধীনতার পিছনে যেটুকু অবদান তা শুধু কংগ্রেস আর গান্ধী-নেহরুরই। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের যেনো কোনো ভূমিকাই নেই। আর স্বাধীনতার একমাত্র পথ ছিলো অহিংস আন্দোলন। কিন্তু অহিংস ছাড়াও ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য সহিংসনেতৃত্বও যে ছিলো, তা এই চলচ্চিত্রটি দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। আর সেই আন্দোলনে দেশভাগের মতো বিষয়ও এড়ানো হয়তো সম্ভব ছিলো।

এই ঘরানার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। তিনি বিশ্বাস করতেন, অহিংস পথে নয়, শক্তি প্রয়োগ করেই ব্রিটিশদের ভারত থেকে বিতাড়িত করতে হবে। এই মন্ত্রকে ধারণ করেই নেতাজি আমৃত্যু লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। ঐতিহাসিকরা নেতাজির মূল্যায়ন করে বলেন, ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নেতাজীর অসাম্প্রদায়িক নেতৃত্বে পরিচালিত হলে ভারত বিভাগের প্রয়োজন হতো না। এবং এড়ানো সম্ভব হতো ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানির নৃশংসতম সাম্প্রদায়িক দাঙা।১২

গান্ধী যে কখনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভালোকে ত্যাগ করতে পারেন, গান্ধী দেখে এমনটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। তিনিও যে অনেকটাই অধীন, নিয়ন্ত্রিত তাও এতে ধোঁয়াটে। কিংবা নিজের দল কংগ্রেসেও যে গান্ধীকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে, বা তার চেয়েও জনপ্রিয় নেতা দলে ছিলো তাও অনেকটা ভাবাতীত! গান্ধীর এসব চরিত্র চিত্রায়ণ করতে অনেকটাই ব্যর্থহয়েছেন অ্যাটেনবরো। চলচ্চিত্রে গান্ধীর এই চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিলো নেতাজির। দীর্ঘদিন একই দলের রাজনীতি করলেও গান্ধী-সুভাষের সম্পর্ক ছিলো দা-কুমড়ার। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে হরিপুরা কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে গান্ধীজির পরোক্ষ বিরোধিতা সত্ত্বেও সুভাষ চন্দ্র বসু নির্বাচিত হন। মূলত এতকাল সভাপতি নির্বাচনে গান্ধীজির ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটতো।

হরিপুরায় পরোক্ষভাবে করলেও ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা কংগ্রেস নির্বাচনে প্রত্যক্ষভাবে সুভাষের বিরোধিতা করেন গান্ধী। কিন্তু এবারও জিতে যান সুভাষ। নির্বাচনের পর গান্ধী বলেন, ... পট্টভি সিতারামায়ার পরাজয় আমারই পরাজয়। ... হাজার হোক সুভাষবাবু দেশের শত্রু নন! ... তার জয়ে আমি আনন্দিত। ... আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, গোড়া থেকেই আমি তাঁর (সুভাষের) পুনঃনির্বাচনের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলাম। এর কারণ আজ আমি বলতে চাই নে।১৩ দীর্ঘদিন পরে হলেও এর কারণ হয়তো অরুন্ধতী উদ্ধার করতে পেরেছেন; তার ভাষায়¾হাত্মা গান্ধী এদেশের প্রথম কর্পোরেট স্পনসরড এনজিও। ... আমি ওনাকে নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছি ... তার ভিত্তিতেই এই মন্তব্য করেছি।১৪

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে, সেক্ষেত্রে কংগ্রেস বা গান্ধীর কী ভূমিকা ছিলো তা চলচ্চিত্রের কোথাও পাওয়া যায় না। অথচ এই যুদ্ধ শেষের মাত্র দুই বছরের মাথায় ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে। এ সময় নেতাজি তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ নিলেও গান্ধী নেন ব্রিটিশদের পক্ষ। নেতাজি বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশরা কবে ভারতীয়দের স্বাধীনতার অনুমোদন দিবে, তার জন্য বসে না থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নেওয়া উচিত।

তাই তিনি আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানি যান। ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলারের সাহায্য কামনা করেন। অথচ এ নিয়ে বিতর্কের ঝড় তোলেন গান্ধী ও কংগ্রেসের নেতারা। নেতাজিও তার এ কর্মকাণ্ডের পক্ষে কড়া যুক্তি তুলে ধরে বলেন, অক্ষ শক্তির আক্রমণ থেকে নিজেদের সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য যদি ব্রিটেন আজ আমেরিকার দ্বারস্থ হতে লজ্জা না পায়; তাহলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে অপর কোনো জাতির সাহায্যপ্রার্থী হওয়া আমার পক্ষে অন্যায়ও নয়, অপরাধও হতে পারে না।১৫

এতক্ষণে হয়তো পাঠক ক্ষমতাসীনদের হাতে নির্মিত চলচ্চিত্র বা ইতিহাস চর্চার সঙ্কটটা ধরতে পেরেছেন। এটা যে শুধু ভারতে ঘটেছে তা নয়। পৃথিবীর সব দেশেই এ রকম হয়। আমাদের বাংলাদেশেও হয়েছে, হচ্ছে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে কাগমারী সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের ওয়ালাকুমুসসালামবলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ডাক দিয়েছিলেন। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমানের নাম হাজার বার আসলেও ভাসানীকে খুঁজে পাওয়া দায়। এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমদ দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। অথচ বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই অপরিচিত এই তাজউদ্দিন!

‘গান্ধী যখন মহাত্মা

গান্ধী যখন মহাত্মাটাইটেলটি নিম্নবর্গ ইতিহাসের তাত্ত্বিক শাহিদ আমিনের কাছ থেকে ধার করা। ধার করার কারণ, টাইটেলটির সঙ্গে গান্ধী ও গান্ধীর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। চলচ্চিত্র তার দৃশ্যকল্পের সাহায্যে মানুষের মনে সহজেই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। যার প্রভাব অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের চেয়ে একটু বেশিই। আর আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে এটি যেমন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়, তেমনই ধারণ করে রাখা সম্ভব হয় দীর্ঘকাল। ফলে একসময় হয়তো প্রকৃত গান্ধী নয়, চলচ্চিত্রের গান্ধীই টিকে থাকবে মানুষের দৃশ্যপটে। তাই চলচ্চিত্রে গান্ধীর মহাত্মা নির্মাণও টিকে থাকবে যুগ যুগ ধরে। ফলে বাস্তব জীবনে ও চলচ্চিত্রে গান্ধী কীভাবে মহাত্মা হয়ে ওঠেন, তা খোঁজার চেষ্টা জরুরি।

গান্ধীতে দেখা যায়, আফ্রিকা ফেরত গান্ধীকে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে মুম্বাইয়ের (তৎকালীন বোম্বে) অ্যাপেলো নৌ-বন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে জনমানুষের ঢল। জাহাজের সব মানুষ দাঁড়িয়ে গান্ধীকে দেখার চেষ্টা করছে। তার পাশেই ব্রিটিশ রাজের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে গার্ড অব অনার দেওয়া হচ্ছে। অথচ সেদিকে কারো কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। ওখানেই আবার কংগ্রেস এক সভার আয়োজন করে। নৌ-বন্দর থেকে গান্ধী ঘোড়ার গাড়িতে করে বের হলে সেখানেও দেখা যায় অজস্র মানুষ তাদের প্রিয় মুখটি দেখতে এসেছে। ওই সময় জনস্রোত দেখে বল্লভভাই প্যাটেল বলে ওঠেন, ঢেউ, ঢেউ।তারপর বাজার দিয়ে যাওয়ার সময়ও দেখা যায়, মানুষ উপচে পড়েছে গান্ধীকে দেখার জন্য।

মুম্বাইয়ের অ্যাপেলো বন্দরে এতো মানুষের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে গান্ধীকে অনন্য করে তোলে। অথচ ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে গান্ধীর প্রত্যাবর্তনের মাত্র দুই-তিন বছর আগে থেকে ভারতবর্ষের মানুষজন তার নামযশের খবর জানতে শুরু করেছে। সেই মানুষকে দেখার জন্য চলচ্চিত্রে এতো মানুষের উপস্থিতি অবাক করার বিষয়ই বটে। গান্ধী আসার পর সভা হয়েছে সত্য, কিন্তু গান্ধীর জনপ্রিয়তা বোঝানোর জন্য নৌ-বন্দরে যেখানে কিনা ব্রিটিশ কাউকে গার্ড অব অনার দেওয়া হচ্ছে, তার পাশেই কংগ্রেসের সভা দেখালেন অ্যাটেনবরো। জাহাজের প্রায় সব মানুষকেই দেখা যায়, বন্দরে নামা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে গান্ধীকে দেখছে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে হতদরিদ্র মানুষজন, যাদের গান্ধীকে চেনা-জানার কথা নয়, তারাও ভিড় করেছে দেখার জন্য। এটার অবশ্য যথেষ্ট কারণও আছে, গান্ধীকে অনন্য, মহাত্মা করে তুলতে গান্ধীতে এগুলো করা তো অ্যাটেনবরোর জন্য আবশ্যক ছিলো।

আবার গান্ধীর এক ঘণ্টা দুই মিনিট ২০ সেকেন্ডে দেখা যায়, এক বৃদ্ধ গান্ধীর খোঁজ করছেন। গান্ধীকে পাওয়ার পর বিহার থেকে আসা ওই বৃদ্ধ তাদের সমস্যা বলতে শুরু করেন, অনেক দিন ধরে আপনাকে কথাগুলো বলার চেষ্টা করে আসছি। আমাদের ফসল (নীল), আমরা বিক্রি করতে পারি না। আমাদের কাছে কোনো টাকা নেই। কিন্তু ভূস্বামী (ব্রিটিশরা) এখনো একই পরিমাণ খাজনা দাবি করছে। আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কথাগুলো বলা শেষ হলে লোকটি সামনে রাখা খাবার এমনভাবে খেতে শুরু করেন, যেনো অনেকদিন তিনি খান না। এ রকম পরিস্থিতিতে গান্ধী-কস্তুরবার চোখেমুখে কষ্টের ছাপ ভেসে ওঠে। পরে গান্ধী বৃদ্ধের সঙ্গে বিহার যান।

বিহারের মতিহারি স্টেশনে পৌঁছালে দেখা যায়, হাজার হাজার মানুষ গান্ধীকে দেখার জন্য এসেছে। এ সময় এতো লোকের উপস্থিতি দেখে ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তারা অবাক হন। তখন পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে যে কথোপকথন হয় :

পুলিশ কর্মকর্তা ১ : যিশু! উল্টাপাল্টা এসব কী ঘটতে যাচ্ছে?

পুলিশ কর্মকর্তা ২ : আমি জানি না, স্যার। এজেন্ট (ব্রিটিশ) একটা টেলিগ্রাম পেয়েছিলো। সেখানে শুধু বলা হয়েছে, ‘‘তিনি’ আসছেন। আর ট্রেনের সময়টা দেওয়া ছিলো।

পুলিশ কর্মকর্তা ১ : এই অদ্ভুত লোকটি কে?

পুলিশ কর্মকর্তা ২ : আমি জানি না, স্যার।

এই পুলিশ কর্মকর্তারা ঝামেলা হতে পারে ভয়ে গান্ধীকে গ্রেপ্তার করতে যান। কিন্তু তারা এতো লোকের মধ্যে গান্ধীকে গ্রেপ্তার করার সাহস করেন না। পরে গান্ধী ওই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে যান। মুখের উপর মাছি বসছে, তাড়ানোর ক্ষমতা নেই¾এমন করুণ অবস্থায় শায়িত দেখা যায় এক প্রবীণকে। ওই অবস্থাতেই প্রবীণ তাদের এই করুণ অবস্থার কারণ গান্ধীর কাছে বর্ণনা করেন। প্রবীণকে যতটুকু সম্ভব সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতিও দেন গান্ধী।

কোনো রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়া মতিহারি স্টেশনেও এতো লোকের সমাগম অবলীলায় গান্ধীকে মহাত্মা করে তোলে। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ পুলিশ না চিনলেও, ব্রিটিশ-অ্যাটেনবরো কিন্তু গান্ধীকে ঠিকই চিনেছিলেন। চিনেছিলেন বলেই তিনি মানুষের মনোগঠনে ‘মহাত্মা গান্ধীকেই নির্মাণ করেন। অ্যাটেনবরো এভাবে পুরো চলচ্চিত্র জুড়েই গান্ধীকে মহাত্মা করে নির্মাণ করেন। এখন চলচ্চিত্রের বাইরে গিয়ে দেখা যেতে পারে ভারতবর্ষে গান্ধীকে ঠিক কীভাবে মহাত্মা করে তোলা হয়। এই অংশের শুরুতেই শাহিদ আমিনের কাছ থেকে টাইটেল-এর সহায়তা নিয়েছিলাম। এবারে তার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সহায়তা নিবো।

কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি পূর্ব-উত্তর প্রদেশের গোরখপুর জেলায় আসেন। সেখানে আয়োজিত জনসভায় তার ভাষণ শুনতে এক থেকে আড়াই লক্ষ লোকের আবেগপূর্ণ উপস্থিতি ছিলো। বিশাল ওই জনসভায় ভাষণ দিয়ে সেই রাতেই তিনি বারাণসীতে ফিরে যান। ওই অঞ্চলে গান্ধী সশরীরে একদিনের কম থাকলেও তার প্রভাব পরবর্তী কয়েক মাস সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনা জুড়ে ছিলো। তবে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের দিকেও সেখানে কংগ্রেসের অবস্থা সুবিধাজনক ছিলো না। এজন্য কংগ্রেসের সাপ্তাহিকী স্বদেশ-এর সম্পাদক এমন পরিস্থিতির জন্য যথার্থ নেতৃত্বের অভাবকেই দায়ী করেছেন।

কংগ্রেস নেতৃত্বের এই অভাব দূর করতে মহাত্মা গান্ধীর আত্মিক জীবনীর ওপর জোর দিতে থাকে। তাই ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে কংগ্রেস কাউন্সিল নির্বাচন বয়কট করলে ওই বছরের ১১ নভেম্বর স্বদেশ-এ ভোটারদের উদ্দেশে সম্পাদকীয়তে বলা হয়,

এই পবিত্র মূর্তি (গান্ধী) আপনাদের জন্য নিজের তনু মন ধন অর্পণ করেছেন। আপনাদের কল্যাণ করতেই তিনি সন্ন্যাসব্রত নিয়েছেন, জেলে গেছেন, অনেক কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন। অসুস্থ শরীরেও এই মুহূর্তে যে তিনি সারা দেশে ঘুরছেন, এ শুধু আপনাদেরই স্বার্থে। এ হেন মহাত্মা গান্ধীরই উপদেশ¾আপনারা ভোট দেবেন না।১৬

কংগ্রেস নিজেদের নেতৃত্বের সঙ্কট ঘোচাতে সাধুসুলভ ব্যক্তিত্ব, ত্যাগী, দারিদ্রের কষাঘাতে দগ্ধ সত্ত্বেও নিজের আদর্শের প্রতি পূর্ণ অনুগত গান্ধীর উপস্থাপন করতে শুরু করে। গান্ধীর ওপর আরোপ করতে থাকে অনন্যতা। তাই গোরখপুরে গান্ধীর আগমনে চলতে থাকে ব্যাপক প্রচারণা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গোরখপুরের পরম সৌভাগ্য শিরোনামে স্বদেশ-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে দশরথ দ্বিবেদী লেখেন,

প্রার্থনা এই যে গোরখপুরের সাধারণ জনতা কেবলমাত্র মহাত্মাজির দর্শন পেতেই উৎসুক। মহাত্মাজি আসবেন, কৃতার্থ করবেন দর্শন দিয়ে। নিজেদের ত্রাতাকে স্বচক্ষে দেখে মানুষের আনন্দের সীমা থাকবে না। তবে আমার জিজ্ঞাস্য, সরকারের সঙ্গে সরাসরি সহযোগিতা করছে যারা, এ সময় তাদের কোনও কর্তব্য আছে কি না। হৃদয় থেকে যে উত্তর পাই, তা বলে, নিশ্চয় আছে।১৭

গান্ধীর গোরখপুরে আসা সম্পর্কে কংগ্রেসের এই ব্যাপক প্রচারণার ফলে জনসভায় লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে। এই প্রচারণার প্রভাবের কথা আরো জোর দিয়ে বলা যায় এজন্য যে, গোরখপুরের পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ অযোধ্যায় যখন কৃষক বিদ্রোহ হয়ে গেছে, তখনো এ অঞ্চলে তেমন কোনো কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কংগ্রেস তার রাজনৈতিক গুটি হিসেবে গান্ধীর ইমেজের ব্যবহার ওই জনসভার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি। কারণ কংগ্রেস ততক্ষণে বুঝে গেছে, ভারতবর্ষে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের করায়ত্ত্ব করতে গান্ধীর ওপর দেবত্ব আরোপ করতে হবে। তাই গান্ধীকে নিয়ে কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে প্রচার হতে থাকে নানা গুজব।

এ সময় গান্ধীকে নিয়ে বস্তি জেলার মনসুরগঞ্জ থানার সিকন্দর শাহু বলেন, মহাত্মাজিতে তার বিশ্বাস আসবে যদি তার কারখানায় আখের রস ভরা কড়াই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তখনই কড়াইটি ঠিক মাঝখান দিয়ে ভাগ হয়ে যায়। আবার মাঝৌলি থেকে মুরলীধর গুপ্ত লিখে জানান, গোরখপুর থেকে গান্ধী যখন বারাণসী ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন সেলামপুর স্টেশনে তাকে দেখতে পান চাষীর ছেলে এসেছিলো। আসার পথে সে এক ব্রাহ্মণীর কাছে একটি চাদর চায়। ব্রাহ্মণী তা নিষ্ঠুরতার সঙ্গে প্রত্যাখান করলে ছেলেটি কাঁপতে কাঁপতে গান্ধীকে দেখে বাড়ি চলে যায়। পরের দিন ব্রাহ্মণীর বাড়িতে বিষ্ঠাবর্ষণ হয়। শেষে ২৪ ঘণ্টা নির্জলা উপোস আর মহাত্মাজির আরাধনা করে পাপ মোচন করেন ওই ব্রাহ্মণী।১৮

এ রকম অসংখ্য গুজব রটানো হয় গান্ধীকে নিয়ে। সাধারণ মানুষ এসব কথা বার বার শুনে একপর্যায়ে এটাকে বিশ্বাসও করতে থাকে। আর সাধারণের পক্ষে এসব ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের কোনো অবকাশ থাকে না। এভাবেই গান্ধীকে গান্ধী থেকে মহাত্মা করে তোলা হয়। এগুলো শাহিদ আমিন বুঝলেও, গান্ধী নির্মাণ করতে গিয়ে অ্যাটেনবরো কেনো জানি ভুলে যান।

যতো দোষ, ‘মুসলিম ঘোষ

একসময় সভ্যকরার প্রকল্প হাতে নিয়ে এশিয়া, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকাসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে শোষণ করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। এসব দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের মাধ্যমে এগিয়ে চলে ইউরোপের শিল্পবিপ্লব আর অসভ্যদের সভ্য করার কাজ। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে পশ্চিমারা তাদের প্রকল্পের বিষয় ও স্থান পরিবর্তন করেছে। কারণ, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সর্বশান্ত হয়ে এখন অনেকটাই সভ্য। তেলের উপর ভাসা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর অবস্থার এখনো কোনো পরিবর্তন হয়নি! তাই দেশগুলোকে তৃতীয় বিশ্বের গোত্রে আনতে হাতে নিয়েছে ‘মুসলিম জঙ্গিবাদ নিধন প্রকল্প। তেল ও অস্ত্র ব্যবসার লক্ষ্যে এই প্রকল্পের অধীনেই চলছে মুসলিম জঙ্গিদমনের নামে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বে যুদ্ধ-সঙ্কট। কারণ, অস্ত্র বিক্রি করতে না পারলে ধসে পড়বে পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি। আর নিকট ভবিষ্যতে যেনো জ্বালানি সঙ্কটে না পড়তে হয়, সেজন্য চলছে তেল লুটপাট। এসব অপকর্মে যেনো কোনো প্রশ্ন না ওঠে, সেজন্য চলছে জঙ্গিবাদী হিংসাত্মক মুসলিম নির্মাণের অবিরাম প্রচেষ্টা।

অ্যাটেনবরো তাই গান্ধীতেও খুঁজে পান ওই চিরচেনা হিংসাত্মক মুসলিমকে। এই মুসলিমরা যেনো অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই হিংস্র। এবারে চলচ্চিত্রে এর পরিপ্রেক্ষিত দেখা যাক। স্বাধীন ভারতবর্ষের ব্যাপারে কেবিনেট মিশন প্ল্যানের বিরুদ্ধে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট জিন্নাহ প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেন। আলাদা বাসভূমির দাবিতে এদিন মুসলিমরা বিক্ষোভ করলে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেধে যায়, নোয়াখালীতে চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করলেও দাঙ্গা বন্ধে জোর তৎপরতা শুরু করেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী সে সময় মুখ্যমন্ত্রী না থাকলে কলকাতার মুসলমানদের (শহরের ২৪ শতাংশ) রক্ষা করা সম্ভব হতো না।

কিন্তু সোহরাওয়ার্দী তার এই ‘বিতর্কিত ভূমিকার কারণে হিন্দুদের মারাত্মক সমালোচনার মুখে পড়েন। এদিকে কংগ্রেসও কোনো অবস্থাতে কলকাতা ছাড়তে রাজি না। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে এ রকম পরিস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী দিল্লি সম্মেলনে অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু শরৎ চন্দ্র বসু ছাড়া আর কোনো কংগ্রেস নেতা প্রস্তাবটি সমর্থন করেননি। এদিকে জিন্নাহ ও তার সহযোগী মুসলিম লীগ নেতারা দেখলেন, পূর্ব বাংলায় সোহরাওয়ার্দী থাকলে সেখানে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হবে না। তাই ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ আগস্ট জিন্নাহর পরোক্ষ সমর্থনে খাজা নাজিমুদ্দিন মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। সোহরাওয়ার্দী ১৩ আগস্ট খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে পূর্ববঙ্গ এবং ড. প্রফুল্ল ঘোষের কাছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান জন্ম নিলেও সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় থেকে গিয়ে গান্ধীর সঙ্গে একত্রে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধে কাজ করেন।

মহাত্মা গান্ধী দেশভাগের ঘোর বিরোধিতা করলেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অখণ্ড বাংলার প্রস্তাব মেনে নেননি। আবার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অখণ্ড বাংলার প্রস্তাবকে প্রথমে মৌন সমর্থন করলেও পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলন জনপ্রিয় হয়ে উঠলে এর ঘোর বিরোধিতা করেন। পরে জিন্নাহর ইচ্ছাতেই দেশভাগ হয়। আর অখণ্ড বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী উপরের এতো সব বিষয়ের সঙ্গে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অথচ গান্ধীতে জিন্নাহ, গান্ধীর কথা থাকলেও সোহরাওয়ার্দী কেনো জানি নীরব। এতো গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিকে চলচ্চিত্রে শায়িত গান্ধীর পাশে অনেকটা অসহায়, নিষ্প্রাণ, অথর্ব হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এছাড়াও চলচ্চিত্রে মুসলমানদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, শুধু জিন্নাহ নয়, দেশভাগের জন্য সমগ্র মুসলিম জাতিই দায়ী

এছাড়া গান্ধীতে মৌলবাদী সংগঠন হিন্দু মহাসভার হয়ে নাথুরাম গডসে হত্যা করে গান্ধীকে। কিন্তু জিন্নাহর বাড়িতে যখন গান্ধী দেশভাগের বিষয়ে কথা বলতে যাচ্ছিলো, তখন ওই হিন্দু মহাসভার সমর্থকদেরও ভারতবর্ষ যেনো বিভক্ত না হয়, সেজন্য প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। বিপরীতে দেখা যায়, দাঙ্গা রদ করার জন্য মুসলিম নয়, শুধু হিন্দুরাই গান্ধীর কাছে অস্ত্র জমা দিচ্ছে। এতে চলচ্চিত্রে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মুসলিম জিন্নাহ যেমন দেশভাগ চাচ্ছিলেন, মুসলমানরাও যেনো তাই চাচ্ছিলেন! কিন্তু এটা মোটেও প্রকৃত চিত্র ছিলো না।

ওহে কস্তুরবা, তোমার জন্য অন্ধকার!

গান্ধী সারাজীবন ধরে ময়লা সাফ করা নিয়ে জোর লেখালেখি করেছেন। নিজের বিষ্ঠা নিয়ে এতো বেশি হই চই গোটা দুনিয়ায় খুব কম সংখ্যক লোককেই করতে দেখা গেছে। যদিও এর পিছনে অন্য ব্যাপার জড়িত, এখানে সে ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভাবনগরের কাথিয়াওয়ায় এক সম্মেলনে গান্ধী বলেন, যদি আমি কখনও কোন পদ চাই, তাহলে আমি একজন ভাঙ্গির পদ চাইবো। ময়লা সাফ করা অত্যন্ত পবিত্র কাজ, একজন ব্রাহ্মণের জন্য, ভাঙ্গির জন্যও। ... আমি উভয়কেই শ্রদ্ধা ও সম্মান করি।২০ গান্ধীর এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে চলচ্চিত্রে পাশবিক শক্তির পুরুষ হিসেবে তাকে উপস্থাপন করলেন অ্যাটেনবরো। গান্ধীর ২৪ মিনিট ২৫ সেকেন্ড এটা স্পষ্ট বোঝা যায়,

গান্ধী : এটাই নিয়ম। এবং এটা যদি তুমি আনন্দের সঙ্গে করতে পারো করবে, না হলে কোনো প্রয়োজন নেই।

কস্তুরবা : আমার পক্ষে আনন্দের সঙ্গে এ কাজ (পায়খানা পরিষ্কার) করা আদৌ সম্ভব না।

গান্ধী : ঠিক আছে, বেরিয়ে যাও। তোমার এখানে থাকার কোনো অধিকার নেই! একেবারে বেরিয়ে যাও এই আশ্রম থেকে। আমরা তোমাকে চাই না!

কস্তুরবা : তোমার কোনো লজ্জা নেই? আমি তোমার স্ত্রী! ... তুমি কি চাও আমি চলে যাই?

গান্ধীর এই মতের বিপরীতে কস্তুরবার বিকল্প মত থাকতেই পারে কিংবা বিষয়টি তিনি ওইভাবে উপলব্ধি নাও করতে পারেন। কিন্তু চলচ্চিত্রে এই বাগ্বিতণ্ডা চলাকালে গান্ধী তার স্ত্রী কস্তুরবা মাখাঞ্জীকে বাহুবলে টেনে-হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে দিতে উদ্যত হন। নারীর ওপর এমন সহিংসতার বিরুদ্ধে যে গান্ধী নিজেই সোচ্চার ছিলেন, সেই গান্ধীকে দিয়েই অ্যাটেনবরো এমন কাজ করিয়ে নিলেন! নারীর এই অধস্তনতার বিরুদ্ধে গান্ধী বলেন,

নারী ও পুরুষের মধ্যে নারীকেই বিধাতা শ্রেষ্ঠ করিয়া নির্মাণ করিয়াছেন। পুরুষ পাশবিক শরীর শক্তির বলে নারীকে নিজ প্রভুত্বের অধীন করিয়া রাখিয়াছে। পুরুষ নিজের গড়া আইন দ্বারা তাহার প্রভুত্ব আইন-অনুমোদিত করিয়া রাখিয়াছে। শত শত যুগ ধরিয়া ইহাই চলিয়া আসিয়াছে। স্ত্রী হইতেছে স্বামীর প্রণম্য। তাহার বিপরীত প্রথা সৃষ্টি করিয়া পতি দেবতা হইয়া স্ত্রীর পূজা লয়। কিন্তু বিধির বিধান অনুসারে স্বামীরাই স্ত্রীকে প্রণাম করিবে।২১

অ্যাটেনবরো এখানেই থামেননি। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে গান্ধী আইন ব্যবসা করতে দক্ষিণ আফ্রিকায় যান। তবে পরিস্থিতি বদলে গেলে, সেখানে তিনি ভারতীয়দের অধিকার আদায়ে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। বেশ কয়েকবার জেলেও যান। দীর্ঘ ২২ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় কাটিয়ে গান্ধী ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। চলচ্চিত্রে এ সময় গান্ধী পরিবারকে নৌ-বন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে দেখা যায়।

১ম সাংবাদিক : মি. গান্ধী, আপনি কি ইউরোপিয়ান পোশাক পরিধান বাদ দিয়েছেন?

গান্ধী : না, আমি বাদ দেইনি। আমি সাধারণত সেভাবে পোশাক পরতে চেয়েছি, যেভাবে কারাগারে আমার সঙ্গীরা পরতো।

২য় সাংবাদিক : যুদ্ধের প্রচেষ্টাকে আপনি কি সমর্থন করবেন?

গান্ধী : যদি আমি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ভোগ করে থাকি; এটা প্রতিরোধে সাহায্য না করাটা আমার জন্য ঠিক হবে না।

৩য় সাংবাদিক : আপনি ভারতে ফিরে এসেছেন, এখন কী করবেন?

গান্ধী : জানি না। ...

৪র্থ সাংবাদিক : (কস্তুরবাকে লক্ষ করে) একজন ভারতীয় নারী হিসেবে কারাগারে বন্দি হওয়ার বিষয়টিকে (১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকাতে কস্তুরবা ও গান্ধীকে কারাবরণ করতে হয়েছিলো) আপনি কীভাবে নিবেন?

কস্তুরবা : আমার সম্মান আসে স্বামীকে অনুসরণ করার মাধ্যমে।

এবার ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাক। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করা কস্তুরবার সঙ্গে ১৮৮৩-তে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় গান্ধীর। পরে গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় আইন চর্চা করতে গেলে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে সেখানে যান কস্তুরবা। ওখানেই স্বামীর সঙ্গে কস্তুরবার আন্দোলন-সংগ্রামে হাতেখড়ি। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকায় নাগরিক অধিকার ও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে কস্তুরবা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কস্তুরবা সেখানে গ্রেপ্তারও হয়েছেন এবং তিন মাস হার্ড লেবার প্রিজন-এ ছিলেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে গান্ধী ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তন করলে এক সংবর্ধনা সভায় কংগ্রেস নেতা ফিরোজ শাহ মেহতা বলেন, গত দুই তিন বৎসর হইল গান্ধীর নাম এবং যশের কথা ভারতে এত বেশি ব্যক্ত হইয়াছে যে আজকের দিনে গান্ধীর কথা তাঁহার কিছু বলিবার নাই। তবে বলিবার আছে কস্তুরবার কথা যিনি গান্ধীরই সঙ্গে সমানে চলিয়া জেলবরণ করিয়া ভারতীয়দের সম্মান রক্ষা করিয়াছেন।২২

এছাড়া ভারতে ফিরে আসার পর গান্ধী জেলে থাকলে তখন কস্তুরবা স্বামীর বদলে নেতৃত্ব দিতেন। অথচ চলচ্চিত্রে কস্তুরবার এ অবদানের ছিটেফোঁটাও উঠে আসে না, বরং গান্ধীর মহাত্মা ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে মল পরিষ্কার নিয়ে কস্তুরবা কী করেছিলেন, তাই তুলে ধরেন অ্যাটেনবরো!

মিকি মাউসগান্ধী!

পুঁজিবাদী বিশ্বে মানুষ থেকে শুরু করে পশুপাখি বা প্রকৃতির কোনো কিছুই পুঁজির শিকারের বাইরে নয়। শিশুরা তার মধ্যে অন্যতম। এই শিশুদের বাগে আনতে গণমাধ্যম জন্ম দেয় কার্টুন চরিত্রের। আর কার্টুন চরিত্রের মধ্যে অন্যতম মিকি মাউস। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বর মিকি মাউস বাজারে আনে ওয়াল্ট ডিজনি। প্রথম চলচ্চিত্রেই সুপারহিট মিকি। ১৯২৯ থেকে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে মিকি মাউস ফ্যানক্লাবের সদস্য হয় ১০ লাখ শিশু।২৩ আর এই কার্টুনের আয়ের ওপর ভর করেই ওয়াল্ট ডিজনি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন ও প্যারিসে তার পরিবেশন সংস্থার শাখা অফিস খোলে।

এখন বিশ্ব গণমাধ্যম ব্যবস্থাকে যে কয়েকটি কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করছে তার মধ্যে অন্যতম ওয়াল্ট ডিজনি। মিকি মাউস সম্পর্কে এই প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র বলেন, এই চরিত্রটি আমাদের জন্য অন্তহীন এক সম্পদ।২৪ ওয়াল্ট ডিজনির মতো অ্যাটেনবরোর কাছে গান্ধীও এক অন্তহীন সম্পদ। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটি আটটি শাখায় অস্কার জিতে সর্বকালের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্রগুলোর তালিকায় স্থান পায়। আর অ্যাটেনবরো পান সেরা নির্মাতার পুরস্কার। এছাড়া চলচ্চিত্রটি এশিয়া, আফ্রিকা, প্রতীচ্যসহ সারাবিশ্বের বক্স অফিসে ঝড় তোলে ১৯৮২ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আয়ের ১২টি চলচ্চিত্রের একটি হিসেবে সমাদৃত হয়।

গান্ধীর এই ব্যাপক সফলতা চলচ্চিত্রটিকে আর জীবনীভিত্তিক ফিকশন বা কাহিনিচিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, এর আর্থিক সফলতা, সামাজিক স্বীকৃতি এটাকে প্রামাণ্য ইতিহাস হিসেবে মূল্যায়ন করেছে। তাই গান্ধীতে গান্ধীর নির্মাণ নিজেই একটা ইতিহাস হয়ে উঠেছে। ফলে অ্যাটেনবরো গান্ধীতে ভারতীয়দের যে ইমেজ তৈরি করেছেন; ভারতীয় উপমহাদেশ, দেশভাগ এবং স্বয়ং গান্ধী সম্পর্কে যা বলেছেন তার সবই সত্য ও বাস্তব (সত্য ও বাস্তব এই জন্য বলছি যে, চলচ্চিত্রে যা দেখানো হয়েছে তা দেখে বেশিরভাগ দর্শক বাস্তবেও এমনটি ঘটেছে বলে ধারণা করার আশঙ্কা আছে) বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।

ফলে গান্ধী দিয়ে অ্যাটেনবরোর অর্থনৈতিক মুনাফার সঙ্গে সঙ্গে যেটা হয়েছে, তা হলো রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উপনিবেশ নিয়ে তার দেশ ব্রিটেনের যে দুর্নাম ছিলো, তা এই চলচ্চিত্র অনেকখানি নিঃসরণ করেছে। আর এতে অনেকক্ষেত্রেই বৈধতা পেয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। তাই চলচ্চিত্রের ঠিক তিন ঘণ্টার মাথায় মজার ছলে হঠাৎ গান্ধীর একটি আলোকচিত্র দেখিয়ে নাতনিকে দিয়ে গান্ধীকে মিকি মাউস বলিয়ে নেন নির্মাতা। কারণ, অ্যাটেনবরোর কাছে চলচ্চিত্র গান্ধীর তাৎপর্য ডিজনির মিকি মাউসের চেয়েও অনেক বেশি।

পুঁজি বোঝো, মানুষ বোঝো না

শহীদে কারবালাপুঁথিতে কারবালার যুদ্ধ শেষে ইমাম হোসেনের মস্তক নিয়ে ঘাতক সিমার যখন দামেস্ক যাচ্ছিলেন, তখন রাস্তায় নাকি তার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো এক হিন্দু ব্রাহ্মণের! বাঙালি-মুসলমান এই পুঁথিলেখক হিন্দুদের ওপর এতটাই ক্ষ্যাপা ছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের ধু-ধু মরুভূমিতে তিনি ব্রাহ্মণ খুঁজে পেয়েছিলেন! ঘটনা যাই ঘটুক না কেনো, পুঁথিলেখকের মাথায় ছিলো ব্রাহ্মণকে শত্রু বানানোর উদ্দেশ্য, তাই এতো বড়ো ভুল তিনি এড়িয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত লেখক ছিন্ন মস্তকের মুখে কলেমা পড়িয়ে সেই ব্রাহ্মণকে সপরিবারে মুসলমান বানিয়ে ক্ষান্ত দেন। শিল্প-সাহিত্য লেখকের এ ধরনের স্বার্থগত সঞ্চালন (Manipulation) নতুন নয়। প্রাচীন থেকে আধুনিকসব যুগেই ছিলো, আছে। মিশ্র শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও তা আছে; হলিউডে তো এটা এখন পানি-পান্তা। তাই হলিউডি চলচ্চিত্রে ইউ এস সেনারা আফগানিস্তানে খালি বোমা উদ্ধার করে, আর তা নিষ্ক্রিয় করে মানুষ বাঁচায়, একটাও বোমা কিংবা মানুষ মারে না!

আরবের মরুভূমিতে ব্রাহ্মণ খুঁজে পাওয়ার মতো গান্ধীতে দক্ষিণ আফ্রিকার রেল স্টেশনে গরিব ভারতীয় দম্পতিকে খুঁজে পান অ্যাটেনবরো। চলচ্চিত্রের আট মিনিটের মাথায় দেখা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকায় ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরা থেকে ইংরেজরা গান্ধীকে স্টেশনে ফেলে দিচ্ছে। এর পরের দৃশ্যে, কোনো রকম প্রাসঙ্গিকতা ছাড়াই আফ্রিকার সেই স্টেশনে বসে থাকতে দেখা যায় হতদরিদ্র এক ভারতীয় দম্পতিকে। পাশেই তাদের সন্তান কোনো কিছুর জন্য কান্না করছে। শরীরে তাদের মলিন ছেঁড়া-ফাটা কাপড়।

এর মাধ্যমে অ্যাটেনবরো শুধু ভারতীয়দের বিশ্ব দরবারে হতদরিদ্র বলেই তুলে ধরেন না, দেন উপনিবেশের বৈধতা। এ দিয়ে হয়তো বোঝাতে চান, এতো দরিদ্র মানুষদের শোষণ করতে কেউ সুদূর ব্রিটেন থেকে আসে না; তারা এসেছিলেন এই অসভ্য দরিদ্র মানুষগুলোকে সাহায্যের মাধ্যমে সভ্য করতে। উত্তর উপনিবেশে যেমনটি অ্যাটেনবরোও করেন। গান্ধীর ব্যবসায়িক লাভের বড়ো একটা অংশ তিনি উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের জন্য (সেভ দ্য চিলড্রেন-এর তহবিলে) ও গান্ধী আশ্রমসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থায় দান করে দেন।

চলচ্চিত্রের ২৯ মিনিটে দক্ষিণ আফ্রিকায় মিলনায়তনে গান্ধী ভাষণ দেওয়ার সময় এক ভারতীয় দাঁড়িয়ে তার মতামত দেয়। এ সময় ভারতীয় ওই ব্যক্তির পরনের জামাটির দুই কাঁধের, ডান হাতের কনুইয়ের উপরে ও বুকের অংশ ছেঁড়া দেখায়। ৪৪ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডে শুরু হওয়া একটি দৃশ্যে দেখা যায়, গান্ধী ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে নৌ-বন্দর থেকে ঘোড়ার গাড়িতে যাচ্ছিলেন। এ সময় শত শত মানুষের ঢল। তাদের বেশিরভাগের পরনেই জীর্ণ পোশাক, কারো কারো শরীরে কোনো কাপড় নেই। চুল দেখে মনে হয় দীর্ঘদিন ধরে তেল-সাবান জোটেনি। তারা এতটাই দরিদ্র যে, ঘোড়ার গাড়িতে থাকা গান্ধীর কাছে ওই অবস্থাতেই তারা সাহায্যের জন্য হাত বাড়ান। এক দরিদ্র মাকে ফুটপাতে বসে সন্তানকে অপলক দৃষ্টিতে দুধ খাওয়াতেও দেখা যায়। তার পাশে থাকা আরেক মেয়ের উশকোখুশকো চুল ও মলিন বদন দেখে তাদের চরম দুর্গতি বুঝতে কষ্ট হয় না।

এক ঘণ্টা তিন মিনিটে শুরু হওয়া আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, বিহারের মতিহারি রেল স্টেশনে গান্ধী আসলে তাকে হাজার হাজার মানুষ অভ্যর্থনা জানাতে আসে। সেখানেও তাদের পরনে মলিন ছেঁড়া-ফাটা বস্ত্র, আবার কারো কারো শরীরে তাও নেই। তাদের শারীরিক অবস্থা এতো খারাপ যে, যেনো ওখানকার সব মানুষই পুষ্টির অভাবে ভুগছে। এক ঘণ্টা আট মিনিট ২৩ সেকেন্ডের দৃশ্যেও একই চিত্র মেলে। এখন প্রশ্ন, এ দিয়ে ভারতবর্ষ নিয়ে ঠিক কী বোঝাতে চান অ্যাটেনবরো?

ইউরোপিয়রা পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করতে আসে এবং ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে কিছু ব্রিটিশ বণিক মিলে গঠন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই সাদা চামড়ার বণিকরা ভারতীয়দের সভ্য করার নামে ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। পরে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করে বাংলা দখলে নেয় এবং ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। দেওয়ানি লাভের পর থেকে শাসনের নানা পথ পেরিয়ে একশো ৮২ বছর পর অর্থাৎ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভ করে ভারতবর্ষ। দীর্ঘ এ সময় ব্রিটিশরা নাকি ভারতবর্ষের মানুষদের সভ্য করেছে!

অথচ ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে গান্ধীতে বিভিন্ন জনসমাগমে ভারতবর্ষের যে মানুষদের দেখানো হয়েছে, তাদের দেখে মোটেও সভ্যমনে হয়নি। বরং মলিন ছেঁড়া-ফাটা কাপড়, উশকোখুশকো চুল, ক্ষুধার্ত শিশু-বৃদ্ধদের কাছে সভ্যতা নামক ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ ধরা দিয়েছে ঝলসানো রুটি হয়ে। আর এর বিপরীতে সভ্যতার নামে ঢাকা পড়েছে ব্রিটিশদের একশো ৮২ বছরের ভয়াবহ শোষণ। এই শোষণের ফলে প্রতীচ্যে গগনচুম্বী অট্টালিকা উঠলেও ভারতবর্ষ হয়েছে সম্পদহীন, বার বার এসেছে দুর্ভিক্ষ। কিন্তু ব্রিটিশ-অ্যাটেনবরোগান্ধীতে কোথাও ভারতবর্ষের এই করুণ দশার প্রকৃত কারণ নিয়ে একটি ইমেজও নেই!

জলের রঙ সাদা!

১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার পর মহাত্মা গান্ধী গিয়েছিলেন ডারবান ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। সেখানে ইউরোপিয় ম্যাজিস্ট্রেট গান্ধীর মাথায় পাগড়ি দেখে তা খুলে ফেলার নির্দেশ দেন। কিন্তু গান্ধী আদালতের এ আদেশ উপেক্ষা করেন। পরে তিনি এ ঘটনার কড়া সমালোচনা করে সংবাদপত্রে চিঠি পাঠান। এই ঘটনার মধ্য দিয়েই শুরু হয় আফ্রিকায় গান্ধীর লড়াই। এর পরের ঘটনা ডারবান থেকে প্রিটোরিয়া যাওয়ার পথে ট্রেনে। ট্রেনটি পিটারম্যারিটসবার্গ স্টেশনে পৌঁছালে গান্ধীর প্রথম শ্রেণির কামরায় এক শ্বেতাঙ্গ ওঠে। গান্ধীকে প্রথম শ্রেণির কামরায় দেখে শেতাঙ্গ লোকটি রীতিমত থ বনে যান! এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে শ্বেতাঙ্গ লোকটি ট্রেনের এক কর্মকর্তাকে ডেকে নিয়ে আসেন। পরে ওই কর্মকর্তা কোনো রকম যুক্তিতর্ক না মেনে গান্ধীকে পরবর্তী স্টেশনে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেন।

বিষয়টি মেনে নিতে না পেরে গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় সক্রিয়ভাবে আন্দোলন শুরু করেন। এরপর গান্ধী সেখানে বেশ কয়েকটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। গান্ধীর এসব আন্দোলনের মধ্যে অন্যতম ছিলো ডারবানে ভারতীয়দের ডাকঘর ব্যবহার সমস্যা দূরীকরণ। সেখানে ডাকঘরগুলোতে মূলত দুইটি দরজা থাকতো; একটি দিয়ে শ্বেতাঙ্গরা চলাচল করতো, অন্যটি শ্বেতাঙ্গ ছাড়া (নিগ্রো, ভারতীয় ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠী) অন্যান্যদের জন্য। আশ্চর্যের কথা হলো, এক্ষেত্রে গান্ধী কেনো জানি সবার জন্য এক দরজার কথা না বলে, ভারতীয়দের জন্য তৃতীয় একটি দরজার দাবি জানালেন।

যে গান্ধী ভারতীয়দের জন্য বাস্তবে আলাদা দরজার কথা বললেন; সেই গান্ধীকেই চলচ্চিত্রে বর্ণবাদ বিরোধী কথা বলতে দেখা যায়! গান্ধীর এই নির্মাণ অ্যাটেনবরো জেনেই করেন। কারণ এতে ইংরেজ অ্যাটেনবরোর লাভই হয়।

থামছি, তবে অপূর্ণাঙ্গ গান্ধী

১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে জাহাজে করে বিলেত যাচ্ছিলেন গান্ধী। জাহাজে প্রথম তিন দিন গান্ধী আমিষ না খেয়ে ফল ও মিষ্টি খেয়ে কাটান। পরে উড়িষ্যা রাজ্যের জুনাগড়ের উকিল শ্রীত্র্যম্বকলাল মজুমদার জাহাজের খাদ্য পরিচারকদের সঙ্গে কথা বলে গান্ধীর জন্য দেশি নিরামিষ খাবারের ব্যবস্থা করেন। অল্প অল্প করে জাহাজের অন্যান্য লোকজনের সঙ্গে পরিচয় হলে তাদের অনেককেই বলতে শোনা যায়, বিলেতে গেলে মদ ও মাংস না খাইলে বাঁচিবে না। গান্ধী বলিতেন¾এখন তো বেশ চলিতেছে, পরেও এমনি চলবে।২৫ পরবর্তী জীবনে গান্ধী তার এই সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। আবার জীবনের অনেকক্ষেত্রে সেই সংযম ধরেও রাখতে পারেননি তিনি। সময় ও পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে গান্ধীকে।

তার মানে মানুষ বদলায়। তাই একজন মানুষকে মূল্যায়ন করতে হলে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা সময় না ধরে সামগ্রিকতাকে আনতে হয়। বাবা-মা-ভাই-বোনের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন তা দেখার পাশাপাশি দেখতে হয় স্ত্রী-সন্তান-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব-প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক। এছাড়াও ধর্ম-সমাজ-রাষ্ট্র সম্পর্কে তার বিশ্বাস এবং বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন তো আছেই। তারুণ্যের মানুষটিকে যেমন দেখতে হয়, তেমনই দেখতে হয় বার্ধক্যের মানুষটিকেও। খোঁজ করতে হয় গুণমুগ্ধ ও সমালোচক উভয়ের।

অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক সব সম্পর্ক স্থান-কাল-পাত্র ভেদে উঠে না আসলে একজনকে পূর্ণাঙ্গভাবে জানা যায় না। অথচ গান্ধীর ক্ষেত্রে অ্যাটেনবরো পূর্ণাঙ্গ নয়, হাঁটলেন আংশিকের পথেই। গান্ধীতে গান্ধীর সব ভালো দিক তুলে ধরে অ্যাটেনবরো কেনো জানি নির্মাণ করলেন স্বার্থগত সঞ্চালনের ‘অপূর্ণাঙ্গ গান্ধী

লেখক : প্রদীপ দাস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। এর পাশাপাশি তিনি  অনলাইন সংবাদপত্র এনটিভি অনলাইন-এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন।

pradipru03@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. চক্রবর্তী, সুস্মিতা (২০১৪ : ১৮); ফোকলোর ও জেন্ডার প্রসঙ্গ; ফোকলোর ও জেন্ডার : লোক ঐতিহ্যে পিতৃতন্ত্র ও নারীর স্বতন্ত্র স্বর; আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।

২. http://online-dhaka.com/newsarchive/ni/12312/ 

৩. http://goo.gl/pUC0wZ

৪.  https://tinyurl.com/4ub7zayf

৫.  http://www.thereport24.com/article/53817/index.html

৬.  http://oldsite.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=42&dd=2014-08-26&ni=183300

৭. চৌধুরী, ডক্টর কিরণচন্দ্র (১৯৮৩ : ৭৬); বৈদিক যুগোত্তর ধর্ম ও রাজনীতির বিবর্তন; ভারতের ইতিহাসকথা; মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।

৮. সিংহ, যশোবন্ত (২০০৯ : ৪২৫); জিন্না : ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।

৯. চট্টোপাধ্যায়, পার্থ (১৯৯৮ : ৩); ভূমিকা : নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস; নিম্নবর্গের ইতিহাস; সম্পাদনা : গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।

১০. রায়, অরুন্ধতী (২০১৪ : ৩); এক ডাক্তার আর এক সন্ন্যাসী : আম্বেদকার, গান্ধী এবং বর্ণ বিরোধী সংগ্রাম; ভাষান্তর : রক্তিম ঘোষ; সম্পাদনা : শাহেরীন আরাফাত; সাতকাহন মিডিয়া এন্ড পাবলিকেশন্স।

১১.  https://horoppa.wordpress.com/2010/05/12/untouchable-manusamhita-ambedkar/

১২. http://www.voabangla.com/content/birthday-of-netaji-subhas-chandra-bose-114452369/1401205.html  লিঙ্কটির সঙ্গে থাকা অডিওটি শুনুন।

১৩.  http://onushilon.org/corita/suvash-chandra-boshu.htm

১৪.  http://zeenews.india.com/bengali/nation/mahatma-gandhi-was-first-corporate-sponsored-ngo-of-the-country-arundhati-roy_126144.html

১৫. http://www.voabangla.com/content/birthday-of-netaji-subhas-chandra-bose-114452369/1401205.html  লিঙ্কটির সঙ্গে থাকা অডিওটি শুনুন।

১৬. আমিন, শাহিদ (১৯৯৮ : ৪৯); গান্ধী যখন মহাত্মা; নিম্নবর্গের ইতিহাস; সম্পাদনা : গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।

১৭. প্রাগুক্ত; আমিন, শাহিদ (১৯৯৮ : ৫১)।

১৮. প্রাগুক্ত; আমিন, শাহিদ (১৯৯৮ : ৫৩, ৫৫)।

১৯.  http://oldsite.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2012-12-05&ni=117752

২০. প্রাগুক্ত; রায়, অরুন্ধতী (২০১৪ : ৩১)।

২১. দাশগুপ্ত, সতীশচন্দ্র (১৪০৭ বঙ্গাব্দ : পাঁচ); রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী; রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।

২২. প্রাগুক্ত; দাশগুপ্ত, সতীশচন্দ্র (১৪০৭ বঙ্গাব্দ : ১১৯)।

২৩. http://goo.gl/H1Npo1

২৪. http://goo.gl/hW7gdZ

২৫. প্রাগুক্ত; দাশগুপ্ত, সতীশচন্দ্র (১৪০৭ বঙ্গাব্দ : ৬৬)।




বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।



এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন